মিয়ানমার সরকারের হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের মুখে প্রান বাচাতে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বাংলাদেশমুখি হয় রোহিঙ্গা স্রোত। এই সময় মানবতার উজ্জল দৃষ্ঠান্ত রেখে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে পাহাড়ে আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ। ২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস। পুরো বিশ্বে এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ শরণার্থী ক্যাম্প এখন কক্সবাজারে উখিয়া- টেকনাফ।
অষ্টম বছর প্রায় শেষ ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গা, যাদের বেশিরভাগই ২০১৭ সালে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। যা এখনও অব্যাহত রয়েছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। গত দেড় বছরে নতুন করে আরও এক লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন। তারা উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দরজাটি ও তালাবদ্ধ, ক্যাম্পে বেড়েই চলেছে অপরাধ। আর এই সংকট সমাধানের পথও অজানা, অচেনা। গেল ৮ বছরে নানার কূটনৈতিক তৎপরতা দ্বিপাক্ষিও বৈঠক কিন্তু এখন পর্যন্ত একজনকে ও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।
দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া আবার শুরু হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত ১৪ মার্চ জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করার পর প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের বলেন , এই ঈদে না হোক, তবে আগামী রোজার ঈদ যেন আপনারা নিজ মাতৃভূমিতে স্বজনদের সঙ্গে উদযাপন করতে পারেন, সে লক্ষ্যে আমরা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাংলাদেশ হয়ে জাতিসংঘের ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে ‘মানবিক করিডোর’ দিতে সরকার ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ নেওয়ার পর দেশের ‘স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের’ ক্ষেত্রে ঝুঁকির প্রশ্ন তুলে বির্তক উঠেছে, বিরোধিতাও এসেছে রাজনৈতিক দলের তরফে।
এই করিডোর কোন প্রক্রিয়ায় হবে, কোন এলাকায় হবে তা এখনও স্পষ্ট করা হয়নি সরকারের তরফে। তবে এটি করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তরফে কিছু শর্ত দেওয়ার কথা বলেছে সরকার। নিয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের স্পষ্ট বিরোধিতার মুখে অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, জাতিসংঘ উদ্যোগ নিলে সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এই করিডোর তৈরিতে যুক্ত হওয়া নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যেও আছে মতভিন্নতা। এটাকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি বলছেন অনেকে।
রোহিঙ্গারা জাতিগত স্বীকৃতি আর নাগরিক অধিকার নিয়ে স্বদেশে ফিরতে চান :
নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার নিশ্চয়তা নিয়ে নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরতে চান রোহিঙ্গারা। তাই শরণার্থী দিবসে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিকট রোহিঙ্গাদের আবেদন তাদের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার। তবে দেশে যেতে আদৌ পারবে কিনা তা নিয়েও উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় আছে তারা।
রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরার স্বপ্ন দিনদিন ভেস্তে যাচ্ছে। কারণ বাংলাদেশ সীমান্তে রাখাইন রাজ্যে জান্তা বাহিনী ও বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ চলছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাসহ রাজ্যের বিস্তীর্ণ অংশ আরাকান আর্মিদের দখলে রয়েছে।
ওইসব এলাকার অনেক রোহিঙ্গাকে বাস্তুচ্যুত করা হয় এবং মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর অনেক বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। এ অবস্থায় অনেক রোহিঙ্গা তাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন নিয়ে চিন্তিত।
রোহিঙ্গারা বলছেন, ক্যাম্পের জীবন জরাজীর্ণ এবং গণবসতি। অনেকটা একঘেয়ে এবং খাঁচায় বন্দির পাখির মত জীবন অতিবাহিত করেছেন টানা ৮বছর ধরে।
কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং টিভি টাওয়ার এলাকার ৭নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মোহাম্মদ আলী, ‘প্রাণ রক্ষায় এসেছিলাম, এবার ফিরে যেতে চাই।
সহযোগিতা যতোই পাইনা কেন, শরণার্থী জীবন ভাল লাগে না। রোহিঙ্গা বস্তিতে থাকলেও মনটা রাখাইনে পড়ে থাকে। আমরা স্বপ্ন দেখি রাখাইনে ফিরে যাবার।
কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নুরুল হক বলেন ,বাংলাদেশ শুধু চাইলে হবে না, মিয়ানমারকে রাজি হতে হবে নিরাপদ প্রত্যাবাসনে।
আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করলে কেবল প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়ার পথ খুলতে পারে। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সামরিক জান্তার গনহত্যার মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়। সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। তারা আরাকানে জাতিগত নিধন চালিয়ে গেছে।
বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ওপর দ্বিতীয় দফা গণহত্যা চালাচ্ছে। জান্তা সরকার ও আরকান আর্মি মিলে ফের যুদ্ধের নামে সেখানে থাকা রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়া করছে। এটির শক্ত প্রমাণ রয়েছে।
বোমা এবং ড্রোন হামলায় এখন রোহিঙ্গাদের মেরে ফেলা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, এই দেশে আর কত বছর থাকবো? আমরা আর বাংলাদেশের বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। আমরা আমাদের স্বদেশে ফিরতে চাই। মিয়ানমার আমাদের দেশ। অনতিবিলম্বে আমাদের নিজ দেশে ফেরত নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারে ‘সেফজোন’ করে দিলে আমরা এখনই ফিরে যাব। তবে আমাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশ জনগণকে ধন্যবাদ জানায়।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে উখিয়ার সম্মুখ যোদ্ধা হাশেম সিকদার জিসান বলেন, আন্তর্জাতিক মহল সহ রোহিঙ্গা ইস্যুর সকল অংশীদারদের প্রতি আহবান জানায়, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিত করতে দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া হোক। অধিকার বাস্তবায়ন কমিটি, পালংখালীর সভাপতি ইঞ্জি. রবিউল হোছাইন বলেন ‘সঠিক উদ্যোগ না নেয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন যেমন ব্যর্থ হয়েছে তেমনি দীর্ঘ মেয়াদী অবস্থান করায় রোহিঙ্গাদের কারণে শান্তি শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনই আমাদের একমাত্র কাম্য। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ক্রমশ জটিল হয়ে পড়েছে।’ উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সাল থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আসা শুরু হয়। এরপর থেকে কারণ