

৪৭০ বছরের ঐতিহাসিক গজনীর দীঘি। যেখানে রয়েছে এক সম্ভাবনার চিত্র। কিন্তু এখন পর্যন্ত ছোঁয়া লাগেনী সরকারের প্রশাসনের। ফলে দীর্ঘ ঐতিহাসিক এই পর্যটন কেন্দ্রটি পড়ে রয়েছে অবহেলা আর অযন্ত্রের ধুম্রজালে।
এটিও হতে পারে সরকারের একটি অর্থনৈতিক সম্ভাবনার চালিকা শক্তি। আর বরিশালবাসী সহ দেশের মানুষের একটি বিনোদন কেন্দ্র। বরিশাল সদর উপজেলার চাঁদপুরা ইউনিয়নের চানপুরা গ্রামে অবস্থিত ৪৭০ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক গজনীর দীঘিকে ঘিরে রয়েছে স্থানীয় মানুষের নানা কৌতুহল। সরকারের প্রশাসন দ্রুত এই দীঘিকে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের আওতায় এনে আনুষ্ঠানিকভাবে পর্যটন স্পট ঘোষণা করবে এমনটাই প্রশ্যতা গোটা বরিশালবাসীর।
সেই সঙ্গে দীঘির চারপাশে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, পর্যটনবান্ধব পরিবেশ ও উন্নত সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা করাও দাবি তাদের।
স্থানীয়দের মতে, বৈরম খাঁর খনন করা এবং সুফি সাধক গজনী শাহের স্মৃতিবিজড়িত এই দীঘি শুধু একটি প্রাচীন জলাশয় নয়, বরং এটি বরিশালের ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক অমূল্য নিদর্শন। অথচ অব্যবস্থাপনা, অবৈধ দখল ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে এই ঐতিহ্য আজ ধ্বংসের মুখে।
বরিশাল নদী বন্দর পার হয়ে চরকাউয়া খেয়াঘাট থেকে বৈরাগীর বাড়ির পুলের বামদিকে নেহালগঞ্জ সড়কে দুই কিলোমিটার ডান দিকে ধোপা বাড়ির সম্মুখে গজনীর দীঘি।
আর দীঘির পশ্চিম পারে রয়েছে বাতাস ফকিরের মাজার। যেখানে বড় আকারের একটি বাৎসরিক অনুষ্ঠান সহ প্রতিদিনই আসা-যাওয়া উপর থাকে ভক্তবৃন্দ ও দর্শনার্থীরা। কিন্তু ধোপা বাড়ির সম্মুখে গজনীর দীঘি পর্যন্ত অধা কিলোমিটার সড়কটি যাতায়াতের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
তাই সড়কটি তাই স্থানীয় ও দর্শনার্থীদের দাবি দ্রুত সড়কটি সংস্কার করা হোক।
স্থানীয় আঃ হাকিম নামের একজন অভিযোগ করেন, দীর্ঘদিন ধরে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল এই দীঘিকে আত্মসাতের পাঁয়তারা চালাচ্ছে।
কেউ নিজেদের নামে জাল কাগজপত্র তৈরি করছেন, কেউ আবার মামলা দিয়ে সরকারি মালিকানায় জটিলতা সৃস্টি করছেন।
এমনকি দীঘির পশ্চিম উত্তর পাড়ে বসতবাড়ি নির্মাণ করে অনেকে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন। মোঃ কবির নামের অপর এক জন বলেন, গত ১৭ বছরে এখানে প্রায় ২৫/৩০ বসতি গড়ে উঠেছে।
এদের প্রত্যেকেই অন্য স্থানের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও শুধূ মাত্র ভুমি দখলের জন্যই এখানে বসতি গেড়েছেন। এ ছাড়া অবৈধভাবে মাছ শিকার, রাতের আঁধারে গাছ কেটে নেওয়া, জুয়ার আসর, মাদক বিক্রি ও সেবন, দর্শনার্থীদের হয়রানি; সবকিছু মিলিয়ে দীঘি ঘিরে তৈরি হয়েছে এক ধরনের নৈরাজ্য।
এতে স্থানীয়রা যেমন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, তেমনি ভ্রমণপিপাসুরাও দিন দিন বিমুখ হচ্ছেন। ইতিহাস বলছে, মুঘল সম্রাট আকবরের অভিভাবক বৈরম খাঁ ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে এটি খনন করেছেন।
তৎকালীন সময়ে ইসলাম প্রচারের জন্য চাঁদপুরায় বসতি স্থাপন করেছিলেন সুফি সাধক গজনী শাহ, যিনি দীঘির পাড় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। তাঁর নামেই দীঘির পরিচিতি হয় ‘গজনীর দীঘি’। ২৫ একর জমির উপর রয়েছে এই গজনীর দীঘি। এর ১১ দশমিক ৭০ একর জমির ওপর দীঘির পানি।
বিশুদ্ধ পানির জন্য মুঘলরা এই দীঘি খনন করেছিলেন বলে ইতিহাস থেকে জানা গেছে। কয়েক হাজার শ্রমিক দীর্ঘ সময় ধরে খনন করেন এই দীঘি। দীঘিটির পাড় ছিলো অনেক উচ্চুতায়। যেখানে সাধারণ মানুষও উঠতে ভয়পেতো।
বর্তমানেও এই দীঘির পার প্রায় ২৫-৩০ ফুট উচ্চতায় রয়েছে। স্বাধীনতার পরও এখানে জমকালো গজনীর মেলা বসত, যেখানে ঘোড়দৌড়সহ নানা আয়োজন হতো।
কিন্তু ১৯৯১ সালে জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে এক হত্যাকাণ্ডের পর সেই মেলা বন্ধ হয়ে যায়। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকাকালীন ১৯৭৭ সনে এটি সংস্কারের উদ্যোগ নেন।
১২ টি পাম্পের মাধ্যমে এটির পানি সেচ করা হয়েছিলো।
পরবর্তিতে জোট সরকারের ক্ষমতা কালীন ২০০৬ সালে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে একটি সাহায্য সংস্থা এই দীঘিতে ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করে পুনরায় মাছ চাষের আওতায় নিয়ে আসে। তবে দীর্ঘ সময়ে এটি পরিত্যাক্ত থাকায় এবং আওয়ামীরা ক্ষমতায় আসলে ভুমি দস্যুদের দিয়ে দখল বানিজ্য শুরু করে। স্থানীয়দের ভাষ্য, দীঘীর পূর্ব ও দক্ষিণ প্রসস্ত পাড়ের উপরে গড়ে উঠেছে প্রায় ২৭টি বসত ঘর।
এদের মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত ইউপি চেয়ারম্যান জাহিদের বিস্বস্থ সন্ত্রাসী আঃ ছালাম মৃধা, সেলিম মৃধা অন্যতম। বিএনপির অপিস পোড়ানো মামলাসহ শিক্ষার্থীদের উপর হামলা মামলা সরাসরি জড়িত ছিলো বলে অভিযোগ করেন এলাকাবাসী।
বিএনপির কিছু অসাধু ব্যাক্তিদের ছত্রছায়ায় এরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও প্রশাসন রয়েছে নির্বিকার।
এদের লোকজনই এই দীঘির জমি দখল বানিজ্য করে। যাতে করে দীঘির পাড়ের সৌন্দর্য হানি ও প্রসস্থ পাড়ে মাটি খনন করে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। বিগত সরকার আওমীলীগের শাসন আমলে তাদের অনুসারীরা দীঘীর পার দখল করে নিজেদের নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বসতী গড়ে তুলেছে।
এখন প্রশাসনের ন্যূনতম তদারকির অভাবে দীঘি ধীরে ধীরে বেহাত হয়েছে। এক সময় যে দীঘি হাজারো মানুষকে টানত, আজ সেটিই অবৈধ দখল ও অপরাধীদের আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা আবুল শরিফ বলেন, “প্রতিবছর এখানে গজনী মেলা বসত, কিন্তু এখন দীঘির চারপাশে দখলদারিত্ব আর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে এর ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
শাহজাহান মল্লিকের অভিযোগ, “দীঘির দক্ষিণ ও পূর্বপাড় দখল হয়ে গেছে। কেউ খেয়াল রাখছে না। যদি এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, ঐতিহ্যটা পুরোপুরি হারিয়ে যাবে।” স্থানীয় হানিফ ও আব্দুল বারেক হাওলাদারও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন।
বরিশাল বিভাগ উন্নয়ন ও সার্থ সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম খান রাজন বলেন, ‘এই দীঘি আওয়ামী লীগের ভূমিদস্যু দখলদারদের হাত থেকে দ্রুত রক্ষা করা দরকার।
দীঘির পারগুলো থেকে গাছ কাটাসহ বসতবাড়ি গড়ে তুলে এখন পুরো দীঘী দখলের পঁয়তারা করে আসছে একটি মহল। এখন সময়ের দাবি প্রায় ৫০০ বছরের এই প্রাচীন দীঘী দখল মুক্ত করে পর্যটন বান্ধব করে গড়ে তোলার আহ্বান জানান তারা।
এই জন্য যথাযথ প্রশাসন যদি দ্রুত পদক্ষেপ না গ্রহণ করেন তবে আমরা এই দীঘী রক্ষার জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করবো। বরিশাল বিভাগীয় জাদুঘর, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাস্টোডিয়ান আরিফুর রহমান বলেন, “চাঁদপুরা ইউনিয়নের প্রায় পাঁচশত বছরের প্রাচীন গজনীর দীঘি আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক অমূল্য নিদর্শন।
এ দীঘি শুধু অতীতের সাক্ষ্য বহন করছে না, বরং সঠিক সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এটি একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। তাই এ প্রত্নসম্পদকে রক্ষা করার স্বার্থে অবিলম্বে এর সীমানা নির্ধারণ, অবৈধ কার্যক্রম প্রতিরোধ, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি।
বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হাসান জানান, আমরা জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় ঐতিহাসিক যত স্থাপনা এবং ঐতিহ্য আছে সেগুলোকে তুলে ধরতে চাই। পর্যটন ও ইতিহাসের সমন্বয়ে গজনীর দীঘিকে সাজাতে চাই। দীঘিটি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকার পরে সম্প্রতি দুই বছরের জন্য মাছ চাষের জন্য দীঘিটি লিজ দেওয়া হয়েছে।
ইতিপূর্বে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বিগত সময় দর্শনার্থীদের জন্য দীঘির উত্তর ও দক্ষিণ পারে বেশ কয়েকটি বেঞ্চ বসানো হয়েছে।
দীঘির দুটি জানের উপর পানি প্রবাহের জন্য দুটি ঝুলন্ত সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। জেলা প্রশাসক খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এই ঐতিহাসিক স্থানটি পরিদর্শনে যাবেন বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন। বরিশাল জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসনে বলেন, ‘স্থানটির কথা শুনেছি।
খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই আমি স্থানটি পরিদর্শনে যাবো এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবো।